মালগাঁওয়ের মানুষজনকে শান্তি দেয় রুক্ষ শুষ্ক মালভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা দরগাটি। মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার এই উপাসনাস্থল কয়েকশো বছরের পুরোনো, বহুযুগ ধরে তা দুঃখী-তাপীদের আশ্রয়স্থল।

দরগার গা বেয়ে ওঠা গাছটির ছায়ায় বসে স্কুলের হোমওয়ার্ক করে ছেলেমেয়েরা। ফটকের কাছে বসে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন তরুণ-তরুণীরা – গ্রীষ্মের দাবদাহে শুধু এই জায়গাটুকুতেই শীতল হাওয়া বয়। পুলিশের চাকরিপ্রার্থীরা নানান শারীরিক কসরত অনুশীলন করেন দরগার পাশের খোলা মাঠখানায়।

“আমার ঠাকুর্দার পর্যন্ত [ওই দরগা নিয়ে] কত না গল্প আছে,” বলছেন ৭৬ বছরের কৃষক বিনায়ক যাধব; গ্রামে ১৫ একর জমি আছে তাঁর। “ভাবুন তাহলে কত পুরোনো। হিন্দু আর মুসলিমরা মিলেমিশে ওর রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। আমাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটা প্রতীক এই দরগা।”

সব বদলে যায় ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। মালগাঁওয়ের প্রাণপ্রিয় দরগার একটা নতুন পরিচয় জানা যায় হঠাৎ – সংখ্যায় অল্প কিন্তু গলাবাজিতে দড় একদল যুবক দাবি করে ওই দরগা নাকি জবরদখল করে তৈরি। তাদের ইন্ধন দিচ্ছিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী নানা দলের একটি জোট।

২০ থেকে ২৫-এর মধ্যে বয়স মালগাঁওয়ের এই হিন্দু বাসিন্দাদের; তারা জেলা সদরে চিঠি লেখে এই “বেআইনি জবরদখল সম্পত্তি” ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়ে। দরগার পাশের জলের ট্যাংকটি ইতিমধ্যের কারা ভেঙে দিয়ে গেছে। চিঠিতে বলা হয়, “মুসলিম সম্প্রদায় দরগার চারপাশের সর্বসাধারণের জমি দখল করতে চায়।” বলা হয়, “গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমতি ব্যাতিরেকে এই উপাসনাস্থল তৈরি হয়েছে।”

PHOTO • Parth M.N.

মালগাঁওয়ের দরগায় বন্ধুদের সঙ্গে বিনায়ক যাধব (মাথায় গান্ধীটুপি)। মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার এই দরগাটি কয়েকশো বছর ধরে এখানে আছে

কিন্তু যেদিন বুলডোজার দিয়ে দরগা ভেঙে দেওয়ার রব উঠল, গোটা গ্রাম একজোট হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। “১৯১৮ সালের ম্যাপেও এই দরগার উল্লেখ আছে,” সযত্নে জীর্ণ একটা কাগজের ভাঁজ খুলতে খুলতে বললেন যাধব। “এই গ্রামে এমন কত কত ধর্মস্থান সেই স্বাধীনতার আগে থেকে আছে। আমরা সেই সবকিছু সংরক্ষণ করতে চাই। আমরা চাই আমাদের বাচ্চারা শান্তির আবহে বেড়ে উঠুক।”

“ধর্মা ধর্মা মাধে ভান্ডন লাঁও আপন পুঢ়ে নাহি, মাগে জনার [ধর্মে ধর্মে ভেদাভেদ করলে সেটা আমাদের পিছনেই টানবে শুধু],” যোগ করেন তিনি।

হিন্দুত্ববাদীরা দরগা ভাঙার শোর তোলার জবাবে মালগাঁওয়ের দুই সম্প্রদায়ের বর্ষীয়ানরা একজোট হয়ে এই দাবির বিরুদ্ধে চিঠি লেখেন। চিঠিতে স্পষ্ট করে বলা হয় যে দরগা ভাঙার দাবিতে এখানকার সংখ্যাগুরু মানুষের মত নেই। জাতপাত-নির্বিশেষে প্রায় ২০০ জন হিন্দু ও মুসলিম সেই চিঠিতে সই করেন। দরগা বেঁচে যায় – এখনকার মতো।

সামনে আরও বড়ো চিন্তা; বহুকষ্টে অর্জিত এই শান্তি এবার কতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায়।

*****

মুসলিম সম্প্রদায়ের কোনও সৌধকে বাঁচাতে বিভেদকামী শক্তিদের বিরুদ্ধে যেভাবে একজোট হয়ে দাঁড়িয়েছে মালগাঁও গ্রাম, সেটা আসলে খুবই বিরল।

গত দেড় বছরে মহারাষ্ট্রে ক্রমশ বেড়ে চলেছে মুসলিম উপাসনাস্থলগুলির উপর হামলার ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হানাদারেরা পারও পেয়ে যাচ্ছে – পুলিশ কিছু করছে না, সংখ্যাগুরুরাও কোনও উচ্চবাচ্য করছে না।

২০১৯ সালে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের পর আড়াই বছর ভারতের সবচেয়ে ধনশালী রাজ্যের প্রশাসনিক রাশ ছিল তিন দলের জোটের হাতে – শিবসেনা, কংগ্রেস এবং ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি)। মুখ্যমন্ত্রী পদে ছিলেন শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে।

কিন্তু ২০২২-এর জুনে পাশা উলটে যায়; ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) শিবসেনার ৪০ জন বিধায়ককে দল বদল করিয়ে জোটের সরকার ফেলে দেয় এবং নিজেরা ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকেই রাজ্যের আনাচে কানাচে উগ্র হিন্দুত্ববাদী নানান সংগঠন একত্রিত হয়ে সভা-মিছিল করে করে মুসলিমদের নিকেশ করার, তাদের অর্থনৈতিকভাবে একঘরে করে দেওয়ার ডাক দিতে শুরু করে। স্পষ্টতই, রাজ্যের আবহ বিষিয়ে দেওয়ার এটা একটা পরিকল্পিত চেষ্টা; আর মুসলিম ধর্মস্থানগুলির উপর ঘন ঘন নেমে আসা আক্রমণও এই পরিকল্পনারই একটা অংশ।

PHOTO • Parth M.N.
PHOTO • Parth M.N.

বাঁদিকে: দরগার গা বেয়ে ওঠা গাছটির ছায়ায় বসে স্কুলের হোমওয়ার্ক করে ছেলেমেয়েরা। ফটকের কাছে বসে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন তরুণ-তরুণীরা। ডানদিকে: স্কুটি চেপে দরগার পথে যাধব। ‘এই গ্রামে এমন কত কত ধর্মস্থান সেই স্বাধীনতার আগে থেকে আছে। আমরা সেই সবকিছু সংরক্ষণ করতে চাই’, বলছেন তিনি

সাতারা-নিবাসী সমাজকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট মিনাজ সৈয়দ বলছেন রাজ্যে মেরুকরণ ঘটানোর এই পরিকল্পনা বহু বছর ধরেই তলে তলে চলছিল, কিন্তু ২০২২ থেকে তার তীব্রতা বেড়ে গেছে। “দরগা বা সমাধিক্ষেত্রের মতো সৌধগুলি সাধারণত গ্রামের হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশেই দেখভাল করে থাকেন। আজ আক্রমণের মুখে পড়ছে সেগুলিই,” বলছেন তিনি। “আসল নিশানা হল এই বহুত্ববাদী, মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতিটা।”

২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে কোলাপুরের বিশালগড় টাউনে হজরত পীর মালিক রেহান শাহের দরগায় রকেট ছেড়ে দেয় উগ্র হিন্দুদের একটা দল। এই ঘটনা ঘটেছিল পুলিশের উপস্থিতিতেই।

২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে সাতারার পুসেসাবলি গ্রামে একটি মসজিদে মারমুখী তাণ্ডব চালায় বিজেপি নেতা বিক্রম পাওয়াসকরের ছত্রছায়ায় থাকা চরমপন্থী সংগঠন হিন্দু একতা। ইন্ধন ছিল ওয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হওয়া কিছু স্ক্রিনশট, যাদের সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ আছে। ভিতরে শান্তিতে প্রার্থনারত ১০-১২ জন মুসলিমের উপর লাঠি, লোহার রড, টালি ইত্যাদি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জনতা; চরম আঘাতের জেরে মৃত্যু হয় একজনের। পড়ুন: জালি ছবি, ভিডিও আর গুজবের তাণ্ডবে জেরবার মুসলিম জীবন

২০২৩-এর ডিসেম্বরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে কর্মরত গোষ্ঠী ‘সলোখা সম্পর্ক গট’ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে শুধু সাতারা জেলাতেই মুসলিম ধর্মস্থানে হামলার ১৩টি ঘটনার বিবরণ রয়েছে। হামলার ধরন নানারকমের; কখনো তা সমাধিক্ষেত্র ভাংচুর, কখনও বা মসজিদের মাথায় গেরুয়া পতাকা লাগিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক রেষারেষি তৈরি করার চেষ্টা।

পুস্তিকাটি আরও জানাচ্ছে, শুধু ২০২২ সালেই মহারাষ্ট্রে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে ৮,২১৮টিরও বেশি, এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯,৫০০-এরও বেশি মানুষ। গড় হিসেব করলে এই এক বছরে প্রতিদিন ২৩টি করে দাঙ্গা ঘটেছে বলা যায়, যা প্রায় অভাবনীয়।

PHOTO • Parth M.N.
PHOTO • Parth M.N.

বাঁদিকে: সলোখা সম্পর্ক গট প্রকাশিত এই পুস্তিকায় শুধু সাতারা জেলাতেই ১৩টি মুসলিম ধর্মস্থানের উপর হামলার বিবরণ রয়েছে। পুস্তিকাটি আরও জানাচ্ছে, শুধু ২০২২ সালেই মহারাষ্ট্রে দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে ৮,২১৮টিরও বেশি, এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯,৫০০-এরও বেশি মানুষ। ডানদিকে: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক মালগাঁওয়ের দরগা, হিন্দু-মুসলিম মিলে রক্ষণাবেক্ষণ করেন তার

২০২৩-এর জুন মাসের এক সকালে সাতারার কোন্ডওয়ে গ্রামের মসজিদটিতে পৌঁছেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে ৫৩ বছরের শামসুদ্দিন সৈয়দের। মসজিদের গম্বুজের উপরে হাওয়ায় উড়ছে গেরুয়া পতাকা, তাতে কালো অক্ষরে লেখা ‘জয় শ্রী রাম’। সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন সৈয়দ। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন করে অনুরোধ জানান পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। কিন্তু সরু গলির মুখে দণ্ডায়মান পুলিশ বাহিনীর সামনে যখন সে পতাকা নামানো হচ্ছে, সৈয়দের মনে তখনও কু ডেকে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ অশান্তির চিন্তা।

“দিন কয়েক আগে টিপু সুলতানকে নিয়ে একটি স্টেটাস আপলোড করেছিল একটি মুসলিম ছেলে,” জানালেন মসজিদের অন্যতম ট্রাস্টি সৈয়দ। “১৮ শতকের মুসলিম সুলতানের প্রশংসা পছন্দ হয়নি হিন্দুত্ববাদীদের, তাই গ্রামের মসজিদ অপবিত্র করে বদলা নিচ্ছিল তারা।”

অনুশোচনায় ভুগছেন টিপু সুলতানের স্টেটাস আপলোড করা ২০ বছরের সোহেল পাঠান: “একদম উচিত হয়নি,” বলছেন তিনি। “একটা ইনস্টাগ্রাম স্টোরি দিয়ে আমার গোটা পরিবারকে বিপদের মুখে ঠেলে দিলাম।”

পোস্ট করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাঁর নিভু নিভু আলো এক-কামরার কুঁড়েতে এসে হাজির হয় একদল উগ্র হিন্দু। এসেই সপাটে চড় মারে তাঁর গালে। “আমরা আর পালটা কিছু করিনি, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হত,” বলছেন সোহেল। “কিন্তু শুধু একটা ইনস্টাগ্রাম স্টোরি ছিল। ওদের স্রেফ মুসলিমদের আক্রমণ করার একটা ছুতো চাই।”

যে রাতে তাঁকে চড় মারা হয়, সে রাতেই পুলিশ তৎপর হয়ে কেস ফাইল করে – সোহেলের নামে। রাতটা থানায় কাটাতে হয় তাঁকে। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় বৈরিতা ছড়ানোর সেই মামলা এখন জেলা আদালতে উঠবে। যারা তাঁকে চড় মেরেছিল তারা খোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সোহেলের মা ৪৬ বছরের শেহনাজ জানালেন, সাতারায় তাঁরা বহু প্রজন্ম ধরে আছেন, কিন্তু এই ধরনের শত্রুতা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি আগে কখনও দেখেননি। “আমার বাপ-ঠাকুর্দা দেশভাগের সময়ে ভারতে থেকে গেছিলেন, কারণ আমরা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে বিশ্বাস করি,” বলছেন তিনি। “এটা আমার জমি, আমার গ্রাম, আমার বাড়ি। কিন্তু সন্তানরা যখন কাজে বেরোয় ভয়ে বুক কাঁপে আমার।”

PHOTO • Parth M.N.

সাতারার কোন্ডওয়ে গ্রামের বাসিন্দা সোহেল পাঠান নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে টিপু সুলতানকে নিয়ে একটি স্টেটাস দিয়েছিলেন। তার জেরে তাঁর গ্রামের মসজিদে হামলা হয়, তাঁর নিজের বাড়িতে এসে মারধর করে যাওয়া হয় তাঁকে

সোহেল কাজ করেন গাড়ির গ্যারেজে, আর ২৪ বছরের ভাই আফতাব ওয়েল্ডিং-এর কাজ করেন। পরিবারে তাঁরাই শুধু উপার্জন করেন, দু’জনের আয় মিলিয়ে মাসে ১৫,০০০ টাকা মতো আসে। সোহেলের বিরুদ্ধে তুচ্ছ এই মামলাটার কারণে জামিন আর উকিলের বেতনে দুই মাসের উপার্জন জলে গেছে তাঁদের। “দেখছেন তো কীভাবে থাকি আমরা,” ছোট্ট ঘরখানা আর তার রংচটা দেওয়ালের গায়ে কোনওমতে সাঁটিয়ে রাখা আফতাবের ওয়েল্ডিং মেশিনটা দেখিয়ে বললেন শেহনাজ। “কোর্ট-কাছারি করার মতো টাকা আমাদের নেই। একটা ভালো খবর, গ্রামের শান্তিরক্ষা সমিতির মধ্যস্থতায় সবকিছু এখন শান্ত হয়েছে।”

কোন্ডওয়ের শান্তিরক্ষা সমিতির বর্ষীয়ান সদস্য ৭১ বছরের কৃষক মধুকর নিম্বলকর জানাচ্ছেন, ২০১৪ সালে স্থাপনার পর থেকে এই প্রথমবার সমিতিকে কোনও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হল। “যে মসজিদে গেরুয়া ঝান্ডা তোলা হয়েছিল সেখানেই আমরা একটা সভা ডাকি,” জানালেন তিনি। “দুই সম্প্রদায় মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে বিষয়টা আর বাড়ানো হবে না।”

নিম্বলকর বলছেন, সভাটা ভেবেচিন্তেই মসজিদে ডাকা হয়েছিল। “মসজিদের সামনের খোলা জায়গাটায় বহুকাল ধরে হিন্দুদের বিয়েশাদি হয়ে আসছে,” ব্যাখ্যা করলেন তিনি। “আমরা সবাইকে একটু মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যে কীভাবে আমরা এতকাল বসবাস করেছি।”

*****

২২ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে অযোধ্যায় রাম লালার মন্দির উদ্বোধন হয়। ২০১৯-এর নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেয় যে অযোধ্যায় বহুবিতর্কিত জমিতে মন্দিরই তৈরি হবে। চার দশক আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল যে চত্বরে, সেখানেই হবে মন্দির।

তারপর থেকে বাবরি মসজিদের ধ্বংসলীলা ভারতে মেরুকরণের স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা স্বীকার করে নেন যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাটা অসাংবিধানিক ছিল, কিন্তু তারপরেও সেই জমি মন্দির তৈরির জন্য দিয়ে দেওয়ায় সেই ধ্বংসলীলার খলনায়কদের পেশির জোরই বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা।

PHOTO • Parth M.N.
PHOTO • Parth M.N.

২০২৩ সালে গণপ্রহারে আহত ছেলের ফোটো হাতে নাসিম। তিনি যেখানে থাকেন, সেই বর্ধনগড়ে ধর্মীয় সহনশীলতা ও বহুত্ববাদের দীর্ঘ ইতিহাস আছে

মিনাজ সৈয়দ বলছেন, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে ধর্মস্থান বিষয়ে নির্বিবাদ স্থিতাবস্থা বজায় রাখার একটা সর্বজনগ্রাহ্য স্বীকৃতি তৈরি হয়েছিল। “সুপ্রিম কোর্টের রায় সেটা ভেঙে দেয়,” বলছেন তিনি। “কারণ ব্যাপারটা আর বাবরিতে থেমে থাকল না। হিন্দু দলগুলো এখন অন্য মসজিদগুলির উপরেও আক্রমণ শানাচ্ছে।”

সাতারার বর্ধনগড় গ্রামে থাকেন ৬৯ বছরের দর্জি হুসেন শিকলগর। তাঁর গ্রাম, জেলা, রাজ্যে যে হিংসার আবহ ঘনিয়ে উঠছে তাতে একটা স্পষ্ট প্রজন্মগত ভেদাভেদ দেখতে পাচ্ছেন তিনি। “তরুণ প্রজন্মকে পুরোপুরি মগজধোলাই করে দেওয়া হয়েছে,” বলছেন তিনি। “আমার বয়সের লোকজন পুরোনো সময়ের জন্য দুঃখ করে। আজকাল যে উত্তেজনার পরিবেশ দেখি আমাদের সময় তার সিকিভাগও ছিল না। ১৯৯২ সালে আমি গ্রামের সরপঞ্চ নির্বাচিত হয়েছিলাম। আজ নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বলে মনে হয়।”

শিকলগরের কথাটা আরও গভীরভাবে লাগে কারণ তাঁর গ্রামে ধর্মীয় বহুত্ববাদের সংস্কৃতি বহু পুরোনো। বর্ধনগড় দুর্গের পাদদেশে অবস্থিত বর্ধনগড় গ্রাম সারা মহারাষ্ট্রের ভক্তজনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। গ্রামের এক জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় পাঁচটি সমাধিসৌধ আর একটি মন্দির গায়ে গায়ে আছে। হিন্দু আর মুসলিমরা একত্রেই উপাসনা করেন সেখানে। দুই সম্প্রদায় মিলেই চত্বরের দেখভাল করা হয়, বা করা হত, ২০২৩-এর জুলাইয়ের আগে অবধি।

বর্ধনগড়ে এখন সমাধিসৌধের সংখ্যা চারটি। ২০২৩-এর জুনে “অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা” পীর দা-উল মালিকের সৌধ – যেখানে মুসলিমরা নিয়মিত উপাসনা করতেন – সেটিতে ভাংচুর করে যায়। পরের মাসে বনদপ্তর এসে পুরোটা মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যায়, বলে ওটা নাকি বেআইনি নির্মাণ। পাঁচটা সৌধের মধ্যে ওইটিই কেন ভাঙা হল, তা নিয়ে ধন্দে আছেন মুসলিমরা।

PHOTO • Courtesy: Residents of Vardhangad

ভাংচুরের আগে বর্ধনগড়ের সেই সমাধিসৌধ। মুসলিম গ্রামবাসীরা প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের ধর্মস্থানগুলিকেই কেন বেআইনি নির্মাণ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে

“গ্রামের মুসলিমদের খেপিয়ে তোলার একটা চেষ্টা ছিল ওটা,” বলছেন বর্ধনগড়ের বাসিন্দা এবং ছাত্র ২১ বছরের মহম্মদ সাদ। “ওই একই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার একটা পোস্ট নিয়ে আমায় নিশানা করা হয়েছিল।”

গ্রাম থেকে কয়েক ঘণ্টা দূরে পুণে শহরে থাকেন সাদের এক তুতো ভাই; ১৭ শতকের মুঘল সম্রাট আওরংজেবকে নিয়ে একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্ট করেছিলেন তিনি। সেই পোস্টের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই রাতেই সাদের বাড়িতে চড়াও হয় হিন্দুত্ববাদী দলের সদস্যরা; বাড়ি থেকে টেনে বের করে হকিস্টিক আর লোহার রড দিয়ে পেটায় তাঁকে, সঙ্গে চলে গালাগালি “আওরংজেব কি অওলাদ [আওরংজেবের ছেলে]” বলে।

“তখন অনেক রাত, মরেই যেতাম হয়তো,” মনে করছেন সাদ। “ভাগ্যক্রমে তখন ওখান দিয়ে একটা পুলিশের গাড়ি যাচ্ছিল। গাড়ি দেখে দলটা পালিয়ে যায়।”

মাথায় আঘাত, ভাঙা পা আর চিড় ধরা চোয়ালের হাড় নিয়ে আগামী ১৫ দিন হাসপাতালে কাটান সাদ; পরের কয়েকদিন রক্তবমি হয়। আজও একা যাতায়াত করতে সমস্যা হয় তাঁর। “ভয় হয়, আবার যদি হামলা করে,” স্বীকার করলেন তিনি। “পড়াশোনায় মন বসাতে পারি না।”

কম্পিউটার সায়েন্স-এ স্নাতক ডিগ্রির জন্য পড়ছেন সাদ। গুণী, পরিশ্রমী ছাত্র সাদ দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় ৯৩ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলেন। কিন্তু গত কয়েক মাসে নম্বর পড়ে এসেছে তাঁর। “আমি হাসপাতালে যাওয়ার তিন দিন পর আমার কাকা হৃদরোগে মারা যান,” জানালেন তিনি। “৭৫ বছর বয়স হয়েছিল, কিন্তু সুস্থ ছিলেন। হার্টের কোনও সমস্যা ছিল না। উদ্বেগ থেকেই হয়েছে। ওঁর কথা ভুলতে পারি না।”

সেই ঘটনার পর থেকে মুসলিমরা নিজেদের মধ্যেই থাকেন, হিন্দুদের সঙ্গে আর মেলামেশা করেন না। গ্রামের পরিবেশটাই বদলে গেছে। পুরোনো বন্ধুত্বে ফাটল ধরেছে; ছেদ পড়েছে সম্পর্কে।

PHOTO • Parth M.N.
PHOTO • Parth M.N.

বাঁদিকে: ‘গ্রামের মুসলিমদের খেপিয়ে তোলার একটা চেষ্টা ছিল ওটা,’ বলছেন বর্ধনগড়ের বাসিন্দা এবং ছাত্র মহম্মদ সাদ। ডানদিকে: বর্ধনগড়-নিবাসী দর্জি হুসেন শিকলগর বলছেন, ‘সারাজীবন গ্রামের সবার জন্য কাপড় সেলাই করেছি। গত দু’বছরে হিন্দু খদ্দেররা আর আসেন না। রাগ থেকে নাকি চাপে পড়ে, জানি না’

শিকলগর বলছেন, শুধু ওই দুটো ঘটনাই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও থাবা বসিয়েছে এই বিচ্ছিন্নতা।

“আমি তো পেশায় দর্জি,” বলছেন তিনি। “সারাজীবন গ্রামের সবার জন্য কাপড় সেলাই করেছি। গত দু’বছরে হিন্দু খদ্দেররা আর আসেন না। রাগ থেকে, নাকি চাপে পড়ে, জানি না।”

বদলে গেছে রোজকার ভাষাও, যোগ করেন তিনি। “মনে পড়ে না শেষ কবে লান্ড্যা’ শব্দটা শুনেছিলাম,” মুসলিমদের জন্য ব্যবহৃত একটি গালির উল্লেখ করেন তিনি। “আজকাল কান পাতলেই শোনা যায়। হিন্দু আর মুসলিমরা স্বাভাবিকভাবে মেশা বন্ধ করে দিয়েছে।”

পশ্চিম মহারাষ্ট্র, সাতারা যেখানে অবস্থিত, সেই অঞ্চলে বর্ধনগড় কোনও ব্যতিক্রম নয়। গ্রামে গ্রামে ধর্মীয় বিভেদ তৈরি করছে সাম্প্রদায়িক হিংসার আবহ, গ্রামীণ এলাকায় বিয়েশাদি-পালাপার্বণের চেহারাটাই বদলে গেছে।

শিকলগর জানালেন, এককালে বর্ধনগড়ে গণেশ পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি, আর সুফি পীর মহিনুদ্দিন চিস্তির মৃত্যুদিবসের স্মরণে উরস উৎসবে যোগ দিতেন হিন্দুরাও। গ্রামে বিয়ে লাগলে সবাই মিলে আনন্দ করতেন। “সেই সবকিছু এখন হারিয়ে গেছে,” দুঃখ করেন তিনি। “একটা সময় ছিল যখন মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সম্মান জানিয়ে বন্ধ রাখা হত রামনবমী শোভাযাত্রার বাজনাবাদ্যি। এখন আরও জোরে জোরে বাজানো হয় আমাদের বিব্রত করার জন্য।”

তবুও দুই সম্প্রদায়ের একটা বড়ো অংশ এখনও মনে করেন সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। দুই ধর্মের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা দলটা সংখ্যাগুরু অংশের মনোভাব প্রতিফলিত করে না। “ওদের গলার জোর আছে, মাথায় সরকারের হাত আছে, তাই মনে হয় ওরাই সংখ্যায় বেশি,” বলছেন মালগাঁওয়ের যাধব। “আসলে সবাই বিতর্কে না জড়িয়ে শান্তিতে থাকতে চায়, সেই কারণেই হিন্দুরা মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। এই অবস্থাটা বদলানো দরকার।”

যাধব বিশ্বাস করেন, গোটা মহারাষ্ট্র না হলেও অন্তত সাতারা জেলার জন্য একটা উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে মালগাঁও। “যে মুহূর্তে হিন্দুরা দরগা বাঁচাতে এগিয়ে এলেন, ওই উগ্রপন্থীরা পিছু হটে গেল,” জোর দিয়ে বলছেন তিনি। “ধর্মীয় বহুত্বের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার দায় আমাদেরই, মুসলিমদের নয়। আমাদের নীরবতা এই সমাজবিরোধীদের হাতই শক্ত করে।”

অনুবাদ: দ্যুতি মুখার্জী

Parth M.N.

Parth M.N. is a 2017 PARI Fellow and an independent journalist reporting for various news websites. He loves cricket and travelling.

Other stories by Parth M.N.
Editor : Priti David

Priti David is the Executive Editor of PARI. She writes on forests, Adivasis and livelihoods. Priti also leads the Education section of PARI and works with schools and colleges to bring rural issues into the classroom and curriculum.

Other stories by Priti David
Translator : Dyuti Mukherjee

Dyuti Mukherjee is a translator and publishing industry professional based in Kolkata, West Bengal.

Other stories by Dyuti Mukherjee